ড. মো. সাইদুর রহমান: বাংলাদেশের কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের কৃষি অর্থনীতি গ্রামীণ সমাজবিজ্ঞান অনুষদের বিএসসি ইকন. (অনার্স)- এর প্রথম বর্ষের ক্লাসে আমি ১৯৮৯ সালের ৩ ডিসেম¦র প্রথম যোগদান করি। ওরিয়েন্টেশনে যোগদান না করতে পারায় আমি কিছুটা পিছিয়ে ছিলাম এবং সে কারণে অনুষদের সকল শিক্ষককে তখন পুরোপুরি চেনার সুযোগ হয়নি।
পরবর্তীতে বিভিন্ন অনুষ্ঠানের মাধ্যমে অনুষদের সকল শিক্ষককে চেনার সুযোগ হয়। তৃতীয় বর্ষে ওঠার পর রিসার্চ ম্যাথডোলজি কোর্সে শ্রেণি শিক্ষক হিসেবে আজকের ড. শামসুল আলম স্যারকে পাই। দীর্ঘকায়, সুদর্শন ও স্মার্ট একজন স্যারকে পেয়ে বেশ আনন্দ হচ্ছিল। স্যারের বিষয়ে আমার ধারণাকে ক্লাসের বান্ধবীরা সঠিক প্রমাণ করেছিল। আর্থিক প্রয়োজনে ছাত্রজীবনে টিউশনি করতাম। সে কারণে ক্যাম্পাসে আসা-যাওয়ার সময়ও স্যারের সঙ্গে দেখা হতো। প্রথম দিকে শুধু সালাম বিনিময় হতো, এই ভালো আছো? আমার মনে আছে স্যার ক্লাসে অত্যন্ত ফর্মাল ছিলেন। সবসময় পরিপাটি পোশাকে থাকতেন। বেশ গোছালো বলা যায়।
ছিমছাম প্রকৃতির বললেও ভুল হবে না। ছোট প্রশ্ন করলেও দীর্ঘ সময় নিয়ে উত্তর দিতেন। বিষয় ভালোভাবে বুঝলাম কিনা তা বারবার জিজ্ঞেস করতেন। একদিনের ঘটনা না বললেই নয়। স্যার পড়াতে গিয়ে আর স্কয়ারের সমীকরণ বোর্ডে লিখে মান বের করছিলেন। ফরমুলায় ভুল থাকায় মান সঠিক হচ্ছিল না। আমি দাঁড়িয়ে বললাম স্যার ফরমুলায় ভুল আছে বলে ফলাফল মিলছে না। আমার এক বন্ধু বলল স্যার আপনারটাই ঠিক আছে। আমি বললাম না ঠিক নাই। আমাদের বিপরীত অবস্থানের কারণে স্যার তো কিছুটা বিব্রত অবস্থায় পড়ে গেলেন। স্যার কিছুক্ষণ চিন্তা করে বললেন, আমি বইটা নিয়ে আসি। স্যার অফিস রুম থেকে ফিরে এসে যেখানে ভুল আছে তা সঠিকভাবে লিখলেন। ছাত্রছাত্রীদের সঠিক ধারণা দেওয়ার জন্য অফিস রুম থেকে বই এনে যে ধৈর্যের পরিচয় দিয়েছিলেন তা আজও আমি ভুলিনি।
স্যারের সাথে ওইদিন থেকে পরিচয়টা খুব বেশি হয়ে যায়। অবশ্য এর একটি প্রভাব আমার ফাইনাল পরীক্ষার নম্বর প্রাপ্তিতেও ছিলো বলে মনে হয়েছে। আমি শিক্ষক হওয়ার পর সকল ক্ষেত্রে এটা মনে রেখে কোনো কিছু ছাত্রছাত্রীদের সঠিকভাবে না বুঝাতে পারলে বই দেখে বা পরের দিন বিস্তারিত বলার চেষ্টা করি। সে শিক্ষাটা প্রকৃতপক্ষে আমার মধ্যে এসেছিল স্যারের মাধ্যমে। আমার যতদূর মনে আছে, ১৯৯৭ সালে প্রফেসর ড. এমএ সাত্তার মণ্ডল স্যার বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের অধীন একটি প্রকল্পে মাসে আটাশি হাজার টাকা বেতনে লিয়েনে যান। ওই সময়ে মাসে আটাশি হাজার টাকা মানে অনেক টাকা। প্রায় লাখ টাকা মাসে আয় করা। অনেকে শুনলে আশ্চর্য হতো। বাংলাদেশের রাজনৈতিক পরিক্রমায় দীর্ঘ সময় পরে ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ সরকার দেশ পরিচালনার সুযোগ পায়। সাত্তার মণ্ডল স্যার সরকারের পরিকল্পনা কমিশনের সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন।
স্যার পরিকল্পনা কমিশনে চলে গেলে প্রকল্পের ওই পদে প্রফেসর ড. শামসুল আলম স্যার যোগদান করেন। আমাদের স্যার যারা এত বেশি বেতনের কাজে এবং সরকারের উচ্চ মহলে নিয়োজিত হচ্ছেন দেখে আমাদের খুব ভালো লাগত। সরকার বদল এবং আবার আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় এলে ড. শামসুল আলম স্যার ১ জুলাই ২০০৯ সালে পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদান করেন এবং তখন থেকে দীর্ঘ একযুগ পরিকল্পনা কমিশনে কর্মরত আছেন। তিনি ২০১৪ সালে ফেব্রুয়ারি মাস থেকে মহামান্য রাষ্ট্রপতির ১০% কোটায় ক্যাডার সার্ভিসের বাইরে প্রথম সিনিয়র সচিব পদমর্যাদা অর্জন করেন। আমরা জানি রুপকল্প ২০২১-এর আলোকে প্রণীত বাংলাদেশের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা, ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা, সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ড. আলম স্যারের নেতৃত্বে ও অংশগ্রহণে প্রণীত হয়। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনাও স্যারের মাধ্যমে সম্পন্ন হয়েছে।
স্যারের নেতৃত্বে বাংলাদেশ টেকসই উন্নয়ন কৌশলপত্র এবং বাংলাদেশে প্রথম সামাজিক নিরাপত্তা কৌশলপত্র (২০১৫-২৫) প্রণীত হয়েছে। স্যারের অংশগ্রহণে ও নেতৃত্বে ২০১৮ সালে শতবর্ষী বাংলাদেশ বদ্বীপ পরিকল্পনা ২১০০ প্রণীত হয়েছে, সকল মহলে প্রশংসিত হচ্ছে।
ব্যক্তি জীবনে স্যারের সাফল্য অনেক। কৃষি অর্থনীতি বিষয়ে দক্ষতা ও অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে বাংলাদেশ কৃষি অর্থনীতিবিদ সমিতি ২০১৮ সালে স্যারকে স্বর্ণপদকে ভূষিত করে। স্যার ২০১৮ সালে South Asian Network for Economic Modeling (SANEM) Economist of Influence Award কর্তৃক বাংলাদেশে ঊপড়হড়সরংঃ ড়ভ ওহভষঁবহপব অধিৎফ অর্জন করেন করেন। বাংলাদেশ শিক্ষা পর্যবেক্ষণ সোসাইটি তাকে ‘বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম স্মৃতিপদক ২০১৮’ তে ভূষিত করেন। বাউ অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন ২০১৮ সালে শিক্ষা ও গবেষণায় বিশেষ অবদান রাখার জন্য ‘সম্মাননা অ্যাওয়ার্ড’ প্রদান করেন।
গবেষণা ও অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য অবদানের জন্য রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন স্যারকে ‘রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড ২০১৯ প্রদান করেন। তিনি অর্থনীতিতে গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখায় মুজিববর্ষ ২০২০-এ বাংলাদেশে দি¦তীয় সর্বোচ্চ বেসামরিক রাষ্ট্রীয় পদক ‘একুশে পদক’ প্রাপÍ হন। আমরা কৃষি অর্থনীতিবিদরা স্যারের পর্বতসম সাফল্যে গর্র্ববোধ করেছি।
ড. আলম স্যার নেদারল্যান্ডসের ভাগিনিঙ্গেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ডেভেলপমেন্ট ইকোনোমিকস স্কুলে ভিজিটিং প্রফেসর হিসেবে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষাকতায় অংশগ্রহণ করেন পর বঙ্গবন্ধু ‘শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অ্যাডজাঙ্কট ফ্যাকাল্টি হিসেবে কৃষি অর্থনীতিতে স্নাতকোত্তর পর্যায়ে শিক্ষতায় যুক্ত ছিলেন। তিনি বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের গভর্নিং বোর্ডের সদস্য হিসেবে বিগত চার বছর ধরে দায়িত্ব পালন করছেন। ড. আলম স্যার সবোচ্চ পারিচালনা পর্ষদ বাংলাদেশ কৃষি বিশ^বিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে পরপর চার মেয়াদে, পটুয়াখালী বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালযের রিজেন্টস বোর্ডে চতুর্থ মেয়াদে, সিলেট কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটে চতুর্থ মেয়াদ, সিলেট বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তৃতীয় মেয়াদে এবং বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেটের দ্বিতীয় মেয়াদে দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি ১৯৭৪ থেকে ২০১৫ পর্যন্ত বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা ও গবেষণায় নিয়োজিত ছিলেন। অধ্যাপনা জীবনে তিনি ২০০৮ সালে জার্মানির হোমবোল্ট বিশ^বিদ্যালয় এবং বেলজিয়ামের ঘেন্ট বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘ইবাসমাস মুন্ডেস’ ফেলোশিপে ভিজিটিং প্রফেসরের দায়িত্ব পালন করেন। ড. আলম স্যার জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থায় মার্চ ২০০২ থাকে ডিসেম্বর ২০০৫ পর্যন্ত পূর্ণকালীন প্রায় সাড়ে তিন বছর চাকরিরত ছিলেন। ইউএনডিটি বাংলাদেশে সিনিয়র স্কেলে পূর্ণকালীন ১৪ মাস জাতীয় কনসালট্যান্ট হিসেবেও দায়িত্ব পালন করেন।
প্ল্যানিং কমিশনের সদস্য হিসেবে যোগদানের পূর্বে প্রফেসর আলম স্যার, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিচালক, পরিকল্পনা ও উন্নয়ন এবং বিভাগীয় প্রধানের দায়িত্বে ছিলেন। ড. আলম স্যারের গবেষণা গ্রন্থ, পাঠ্যপুস্তকসহ অর্থনীতিবিষয়ক দেশে-বিদেশে প্রকাশিত গ্রন্থসংখ্যা ১৪টি এবং দেশ-বিদেশে প্রকাশিত পিয়ার রিভিউড জার্নালে গবেষণা নিবন্ধ সংখ্যা ৫৫টি। স্যার বিশ্ববিদ্যালয়ে আওয়ামী লীগপন্থী শিক্ষক সংগঠন গণতান্ত্রিক শিক্ষক ফোরামের ১৯৯৮ সালের (১৪০৫ বঙ্গাব্দ) কার্যনির্বাহী সংসদের সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। ওই কমিটির সম্মানিত সভাপতি ছিলেন কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মো. মাহবুবুল করিম স্যার। সেই সংগঠনে আমিও সাধারণ সম্পাদক হিসেবে দায়িত্ব পালন করেছি ২০১৬ সালে (১৪২৩ বঙ্গাব্দ) যখন সভাপতি ছিলেন কৃষিতত্ত্ব বিভাগের প্রফেসর ড. মো. আবদুর রহমান সরকার। আর এ বছর অর্থাৎ ২০২১ (১৪২৮ বঙ্গাব্ধ) সালের কমিটিতে আমি সভাপতি হিসেবে দায়িত্ব পালন করছি।
স্যার সেমিনার, সিম্পাজিয়াম ও সরকারি দায়িত্ব পালনে বিশ্বের ৫০টি দেশ ভ্রমণ করেছেন। ড. শামসুল আলম স্যার সেপ্টেম্বর মাসে অনুষ্ঠিত জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় ২০১০ থেকে ২০১৯ পর্যন্ত দশবার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর রাষ্ট্রীয় সফরে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের সভায় যোগদান করেছেন। ৭-১১ মে ২০১১ ইস্তাম্বুলে অনুষ্ঠিত স্বল্পোন্নত দেশগুলোর সম্মেলনে এবং মে ২০১৬ প্রধানমন্ত্রীর সরকারি জাপান সফরে ড. আলম স্যার মাননীয় প্রধানমন্ত্রীর সফরসঙ্গী ছিলেন। ড. আলম স্যারের পারিবারিক জীবনে স্ত্রী, দুই পুত্র সন্তান ও দুই নাতনি রয়েছে। দীর্ঘ ৭২ বছরের জীবনকালে স্যারের অর্জন ও সাফল্য ঈর্ষণীয়। আমরা স্যারের কর্মময় জীবন অনুসরণ করার প্রত্যয় ব্যক্ত করছি। স্যার আরও অনেক দূর এগিয়ে যাবেন দৃঢ়তার সাথে সে দোয়া করি। আল্লাহ তাআলা স্যারকে সুস্থ রাখুন এবং দীর্ঘ সময় বাঁচিয়ে রাখুন এ প্রত্যাশা করছি। আমাদের আরও একটি গর্বের জায়গা হলো আমরা যেখানেই যাই সেখানে যারা থাকেন তাঁরা যখন শোনেন আমরা সাত্তার মন্ডল স্যার বা শামসুল আলম স্যারের ছাত্র তখন বাড়তি একটা কদর পাই। এটা ভাবলেই মনের অজান্তে চোখের কোণে পানি জমা হয়ে আসে। আমার মনে হয় প্রকৃত শিক্ষক তিনি যার প্রতি ছাত্রছাত্রীদের শ্রদ্ধা এবং ভালোবাসা অপকটে প্রকাশ পায়। সত্যি কথা বলতে কি সেই শ্রদ্ধার জায়গাটা শিক্ষকদের সব সময় মনে রাখা দরকার। অনেক কিছুই হয়তো জোর করে পাওয়া যেতে পারে কিন্তু কোনোভাবেই শিক্ষকের সম্মানের মতো হবে না।
সবশেষে, আমি আমার এ লেখায় শ্রদ্ধেয় শিক্ষক শামসুল আলম স্যারকে আমার মতো করে দেখে এবং অনুধাবন করে তা প্রকাশ করার চেষ্টা করেছি। এত বড় মাপের একজন ব্যক্তিত্বকে, শিক্ষককে এবং শিক্ষাগুরুকে যথাযথভাবে উপস্থাপন করা আমার মতো নগণ্য একজন ছাত্র বা মানুষের পক্ষে মোটেও সম্ভব নয়; এটা জেনেও চেষ্টা করেছি মাত্র। কতটা পেরেছি তা জানি না তবে স্যারের বড়ত্বকে আমি সব সময় বোঝার চেষ্টা করি এবং তার যথাযথ মুল্য দেয়ার চেষ্টা করি। স্যার আমার মানসপটে চির ভাস্বর হয়ে আছেন এবং থাকবেন। সামনে যত অগ্রসর হব ততই আমাদের শ্রদ্ধেয় শিক্ষকদের আদর্শকে বড় করে দেখতে পাবে বলে আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি।
লেখক: ড. মো. সাইদুর রহমান, কৃষি-অর্থনীতিবিদ, অধ্যাপক, কৃষি অর্থনীতি বিভাগ, বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়।