রঞ্জন মল্লিক: ৪ নভেম্বর, বৃহস্পতিবার একদল শিশু ঢাকার রাজপথে গলায় প্লেকার্ড ঝুলিয়ে এবং সাদা কফিনের খাটিয়া নিয়ে মৌন মিছিল করে। ব্যাপার কি? কার কফিন শিশুরা বহন করছে। বিষয়টি কৌতুহল সৃষ্টি করে। কাছে গিয়ে দেখা গেল কফিনে চিরনিদ্রায় শায়িত আমাদের অতি পরিচিত ধরণি অর্থাৎ সবুজ পৃথিবী। এসবের কারণ কি? কারণ হলো গ্লাসগোতে তখন চলছে বিশ^ জলবায়ু সম্মেলন। সেই সম্মেলনে বিশ্বের ১২০টি দেশের রাষ্ট্র ও সরকার প্রধান, ২০০ দেশ থেকে প্রতিনিধি, পরিবেশ ও মানবাধিকার কর্মী, বিজ্ঞানী, বিভিন্ন সংস্থা এবং সংবাদ মাধ্যমের প্রতিনিধিসহ প্রায় ৩০ হাজার লোকের সমাগম ঘটে। সবার উদ্দেশ্য ও লক্ষ্য একটিই এই বিশ্বকে কিভাবে কার্বনমুক্ত রাখা যায়। কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো কিভাবে কার্বন নিঃসরণ স্বাভাবিক মাত্রায় আনতে পারবে তাই নিয়ে আলোচনা। এই সম্মেলন বা আসর প্রতি পাঁচ বছর অন্তর অন্তর বসে। ২০১৫ সালে জলবায়ু সম্মেলন হয়েছিল প্যারিসে। সে সময়ও দীর্ঘ আলোচনা পর্যালোচনার ও সমালোচনার পর বিশ্বনেতারা সিদ্ধান্তে উপনীত হন, পরিবেশের ভারসাম্য রক্ষার জন্য কয়লা ও তেলের মতো জীবাশ্ম জ্বালানির ব্যবহার সর্বোচ্চ মাত্রায় কমাতে হবে।
এই জ্বালানি পোড়ানোর ফলে বাতাসে কার্বন-ডাই অক্সাইড নিঃসরণ করে, যা ধীরে ধীরে বায়ুম-লের ওজন স্তরকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। বায়ুমণ্ডলে অতি বেগুনি রশ্মি ও সূর্যের তাপমাত্রা বৃদ্ধি পাচ্ছে। ফলে ধরিত্রী বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। দেখা দিচ্ছে মানবিক বিপর্যয়। এই অবস্থা বিবেচনায় নিয়ে চলতি শতকের মধ্যে তাপমাত্রা বৃদ্ধি যাতে প্রাক শিল্পায়ন যুগের চেয়ে দেড় ডিগ্রির বেশি না হয়, সে ব্যাপারে ঐকমত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। সেই সঙ্গে ২০৫০ সালের মধ্যে যে পরিমাণ ক্ষতিকর গ্যাস নির্গত হবে বায়ুমণ্ডল থেকে, সেই পরিমাণ গ্যাস অপসারণ করে ‘ নেট জিরো ’ অর্জনের সিদ্ধান্ত হয়। প্যারিস চুক্তি বাস্তবায়নে বিশ^নেতারা কি পদক্ষেপ নিয়েছে বা নিচ্ছে তা সবাই অবগত।
করোনার কারণে জলবায়ু সম্মেলন এক বছর পিছিয়ে ২০২১ সালে আবারও বসে গ্লাসগোতে। আমরা দেখতে পাই সম্মেলনে চীন ও রাশিয়ার প্রেসিডেন্টের অনুপস্থিতি, মার্কিন প্রেসিডেন্ট সম্মেলনে বসে ঝিমুচ্ছেন এবং ঘুম থেকে উঠে না বুঝেই হাততালি দিচ্ছেন। এই বিষয়গুলো পত্র-পত্রিকায় ক্ষোভ ও হাসির ঝড় তুলেছে। এখান থেকে যে বিষয়টি পরিষ্কার হচ্ছে, তা হলো আজকাল কোন ধরনের আন্তর্জাতিক চুক্তির প্রতিই রাষ্ট্রের আর সে রকম কোন দায় নেই। স্ব স্ব উন্নত রাষ্ট্র সমূহের পাগলা ঘোড়া নিয়ে ছুটছে তারা। যে কয়েকটি দেশ এক্ষত্রে নিজ থেকে দায়িত্বশীল আচরণ করার অবস্থান রয়েছে, তাদের শেষ পর্যন্ত অন্যদের পথ অনুসরণ করতে হচ্ছে। বিষয়টি নতুন করে ভাবিয়ে তুলেছে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে অরক্ষিত উন্নয়নশীল দেশগুলোকে।
গ্লাসগো সম্মেলনে জাতিসংঘের মহাসচিব এ্যন্থনিও গুতেরেস সার্বিক পরিস্থিতিতে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তথাকথিত উন্নয়নের নামে নিজেদের কবর রচিত হচ্ছে উল্লেখ করে জানিয়েছেন, গোটা বিশ্ব আজ টয়লেটে পরিণত হচ্ছে। সম্মেলন শেষে স্বাক্ষর হওয়া চুক্তিগুলো নিশ্চিত করে বলা যায় প্যারিস চুক্তির মতো কাগজে কলমে সীমাবদ্ধ থাকবে। বড়দের দেখাদেখি শিশুরাও প্লেকার্ড নিয়ে রাস্তায় মিছিল বের করবে। এ ক্ষেত্রে উন্নত দেশগুলোর অন্তরিকতার ঘাটতি থেকেই গেল। অথচ কার্বন নিঃসরণের ব্যাপারে উন্নত দেশগুলোর ৯০ শতাংশই দায়ী।
গ্লাসগোতে সেমিনার সিম্পোজিয়ামের কমতি নেই এ সময়। ৪ নভেম্বর বৃহস্পতিবার কপ-২৬ এর পঞ্চম দিন। এ দিন জ্বালানি নিয়ে আলোচনা হয়। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য গ্রীন হাউজ গ্যাসগুলোর মধ্যে কার্বন-ডাই-অক্সাইড সবচেয়ে বেশি দায়ী। আর কয়লা হলো কার্বনের বৃহত্তম উৎস। তাই কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে ৪০টির বেশি দেশ এবং ১৫০টি সংগঠন ও কোম্পানি একটি চুক্তি করে। পরবর্তীতে আরও দেশ ও প্রতিষ্ঠানের এতে যুক্ত হবার সম্ভাবনা রয়েছে। দুই পর্যায়ে কয়লা ব্যবহার বা কয়লা প্রকল্পে দেশে বিদেশে বিনিয়োগ বন্ধ করতে সম্মত হয়েছে স্বাক্ষরকারী দেশগুলো। ধনী দেশগুলো ২০৩০ সালের মধ্যে তা বাস্তবায়িত করবে। আর গরীব দেশগুলো আরও ১০ বছর পর ২০৪০ সালে কয়লার ব্যবহার বন্ধ করবে বলে আশা করা হচ্ছে। পোলান্ড, ভিয়েতনাম এবং চিলিসহ কয়েকটি দেশ কয়লার ব্যবহার বন্ধ করতে সম্মত হলেও অষ্ট্রেলিয়া, চীন, যুক্তরাষ্ট্র বা ভারতের মতো শীর্ষ কয়লা ব্যবহারকারীরা এই চুক্তিতে নেই। তবে এশিয় উন্নয়ন ব্যাংক, বহুজাতিক সিটি ব্যাংক এবং এসএসবিসি ব্যাংকসহ প্রায় ১৫০টি প্রতিষ্ঠান ও সংগঠন কয়লা সংশ্লিষ্ট প্রকল্পে ধীরে ধীরে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়েছে।
গ্লাসগো সম্মেলনে এবার আফ্রিকার দেশগুলো পরিবেশ বিপর্যয় নিয়ে বেশ হই চই করছে। আফ্রিকার দরিদ্র ও ঝুঁকিপূর্ণ দেশগুলোতে সহায়তার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়কে চাপ প্রয়োগ করছে অঞ্চলটির নেতা ও ক্যাম্পেইনাররা। জলবায়ু হুমকি মোকাবিলায় দ্রুত খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য এ সহায়তা প্রদানের আহবান জানানো হয়। বিশ্বব্যাপি পরিবেশগত হুমকি ও উষ্ণায়নের ফলে মহাদেশটিতে সবচেয়ে বেশি প্রভাব পড়বে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। এজন্য তারা সহায়তার জন্য চাপ প্রয়োগ করছে। আফ্রিকান ইউনিয়নের প্রধান ও কঙ্গোর প্রেসিডেন্ট ফেলিক্স শিসেকেডি জানান, বিশে^র অন্যান্য দেশগুলোর উচিত জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির মোকাবিলায় প্রতিশ্রুত ২ হাজার ৫০০ কোটি ডলারের অর্ধেক পরিমাণ সহায়তা আফ্রিকাকে দেওয়া। আগামী পাঁচ বছরের জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকি মোকাবিলায় এ পরিমাণ অর্থসহায়তা প্রয়োজন। সম্মেলনে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আফ্রিকার দুর্দশার কথা তুলে ধরা নেতাদের মধ্যে তিনি অন্যতম। জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য সবচে কম দায়ী হলেও মহাদেশটি সবচে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। আফ্রিকার ৫৪টি দেশের কার্বন নিঃসরণের মাত্রা মাত্র ৩ শতাংশ। সাধারণ আফ্রিকানদের জন্য এটি একটি অবাক করা সত্য। আফ্রিকার বর্তমান পরিস্থিতি এমন দাঁড়িয়েছে যে, নেতাদের এখন মানিয়ে নাও, নয়তো মরে যাও অবস্থা। জলবায়ু পরিবর্তনের যে প্রভাব তা আফ্রিকার দোরগোড়ায় কড়া নাড়ছে। উল্লেখ্য, মাদাগাসকারের মহিলারা জলবায়ু পরিবর্তনের হুমকির ফলে কৃষিকাজ করতে অক্ষমতা ও একটি অন্ধকার ভবিষ্যতের কথা ইঙ্গিত করছেন বলে মন্তব্য করেন কপ-২৬ এর নেতৃত্ব প্রদানকারী ব্রিটিশ কর্মকর্তা অল শর্মা। তিনি আরও বলেন, প্রয়োজনগুলো অত্যাবশ্যকীয় হয়ে দাঁড়িয়েছে, একই সঙ্গে বৈষম্যও কঠিন আকার ধারণ করছে।
এক্ষেত্রে দক্ষিণ এশিয়ার ঘনবসতিপূর্ণ দেশ বাংলাদেশ লন্ডনের ওয়েস্টমিনিস্টার স্পিকার্স হাউজ স্টেট রুমে ‘বাংলাদেশ অ্যাট ফিফটি: দ্য রিজিলেন্ট ডেলটা’ অনুষ্ঠানে বাংলাদেশের অব¯’ান তুলে ধরেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি ভাষণে বলেন, স্বাধীনতার ৫০ বছরে বাংলাদেশ একটি সম্ভাবনার ও প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের দেশে রুপান্তরিত হয়েছে। অতীতের স্থিতিস্থাপকতা থেকে দেশ শক্তি অর্জন করছে। এখন দেশ সুযোগ গ্রহণের জন্য প্রস্তুত। একটি মিশন ও ভিশন নিয়ে তাকিয়ে আছে ভবিষ্যতের দিকে। বাংলাদেশকে অন্যতম জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ দেশ হিসেবে উল্লেখ করে তিনি বলেন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনায় আমরা অন্যতম রোল মডেল হিসেবে স্বীকৃত। আমরা জলবায়ু অভিযোজনে বিশ্ব নেতা। আমরা এখন জলবায়ু সহনশীলতা নিয়ে কাজ করছি। সম্প্রতি আমরা ১০টি কয়লাভিত্তিক কয়লা বিদ্যুৎ কেন্দ্রের পরিকল্পনা বাতিল করেছি।
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিশ্ব জলবায়ু সম্মেলনে শুধু বাংলাদেশেরই প্রতিনিধিত্ব করছেন না, তিনি ৪৮টি উন্নয়নশীল জলবায়ু ঝুঁকিপূর্ণ অরক্ষিত দেশেরও নেতৃত্ব দিচ্ছেন। তিনি Climate Vulnerable Fourm ev CVF এর একজন সম্মানীত সদস্য। তিনি সম্মেলনে স্পষ্ট ভাষায় বলেছেন, ধনী দেশগুলো প্রশংসনীয় ভাবে আগামীতে তাদের প্রতিশ্রুতি রক্ষা করবে। সিভিএফ জোট ধনী দেশগুলো কাছে ইতোমধ্যে ৫০০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার ২০২৪ মধ্যে হস্তান্তরের প্রস্তাব রেখেছে, যা দিয়ে ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলো তাদের দেশের জলবায়ু পরিবর্তনে কার্যকর ভূমিকা রাখবে।
লেখা শুরু হয়েছিল শিশুদের প্লেকার্ড নিয়ে, যেখানে শিশুরা বলছে হে মানুষ পথে নামো, পৃথিবী মহাসংকটে। আপনার আপনজন যখন সংকটে থাকে আপনি কি পঞ্চাশ তলা ইমারতে বসে বাঁশি বাজাতে পারবেন? শিশুরা তাই বিশ্ব বিবেকের কাছে প্রশ্ন রেখেছে। দেশ যত ধনী বা প্রভাবশালী হোক না কেন প্রকৃতি বৈরী হলে কেউ রক্ষা পাবে না, ইতোমধ্যে মহামারি করোনা তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ। আর বড় আকারের সুনামি, ভূমিধস, ভূমিকম্প, খড়া বা দাবানল হলে কি হবে পৃথিবীর – তখন ধনী বা গরীব রাষ্ট্র কেউ ভেবে দেখার সময় পাবে না। এ্যালার্ম বাজবে- Time is over.
রঞ্জন মল্লিক: সাংবাদিক।