ড. শামসুল আলমকে যেভাবে দেখেছি

ড. নাজনীন আহমেদ: স্বাধীনতা-পরবর্তী বাংলাদেশে পরিকল্পনা কমিশন প্রতিষ্ঠার মূল লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য ছিল সুনির্দিষ্ট ও কাঠামোগতভাবে শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রণয়ন করে দেশকে উন্নয়নের পথে এগিয়ে নিয়ে যাওয়া। প্রাথমিকভাবে পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়ন ও তার বাস্তবায়নের মাধ্যমে এ কমিশন বলিষ্ঠ ভূমিকা রাখলেও পরবর্তী সময়ে নানান কারণে দেশের সার্বিক অর্থনৈতিক কার্যাদি পরিচালনা ও উন্নয়নের যাত্রাপথে এই কমিশনের ভূমিকা অস্পষ্ট হয়ে পড়ে।

কিন্তু পরিকল্পনা কমিশনের সেই অস্পষ্ট ভূমিকাকে সুস্পষ্ট করে দেশের উন্নয়নে শক্তিশালী পরিকল্পনা প্রণয়ন তার বাস্তবায়নের কৌশলপত্র নির্ধারণ এবং নির্দিষ্ট বিরতিতে পরিকল্পনাসমূহের বাস্তবায়নের অগ্রগতি পর্যালোচনা ও ব্যবস্থা গ্রহণ ইত্যাকার ক্ষেত্রে পরিকল্পনা কমিশন গত এক যুগ ধরে নতুন রূপে আবির্ভূত হয়েছে। আর এর পেছনের মূল কাণ্ডারি নিঃসন্দেহে পরিকল্পনা কমিশনের সিনিয়র সচিব প্রফেসর ড. শামসুল আলম। এক যুগ আগে ২০০৯ সালে এ কমিশনের হাল ধরেন তিনি। তারপর থেকে একের পর এক নানামুখী পরিকল্পনা ও উন্নয়ন কৌশলপত্র প্রণয়ন, সেগুলোর বাস্তবায়ন, অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ ও মুল্যায়ন, নতুন ধ্যানধারণার মাধ্যমে পরিকল্পনাগুলোর সার্বিক কলেবর ও বৈশিষ্ট্যগত পরিবর্তন সাধন অনবরত চলছে তাঁরই নেতৃত্বে। তাঁর নেতৃত্ব প্রণীত সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নে গঠিত অর্থনীতিবিদ প্যানেলের সদস্য হিসেবে ছিলাম আমি। এই পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের পুরো প্রক্রিয়ায় তাঁকে যেভাবে দেখেছি এবং সেই সাথে আমার গবেষণার কাজে তার নেতৃত্ব প্রণীত পরিকল্পনা কমিশনের বিভিন্ন রিপোর্ট যেভাবে আমাকে উপকৃত করেছে, সেই আলোকে কিছু কথা লিখছি তাছাড়া বিভিন্ন সময়ে মিডিয়ার নানা টক শোতে তার সাথে অংশগ্রহণ করে যে অভিজ্ঞতা আমার হয়েছে তা নিয়েও কিছু লিখতে চাই।

আমি অর্থনীতিতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অনার্স ও মাস্টার্স শেষে এই বিষয়ে গবেষণাকেই পেশা হিসেবে নিই। তারপর বিদেশে স্কলারশিপ নিয়ে আবারও উন্নয়ন অর্থনীতিতে মাস্টার্স করি এবং পরবর্তী সময়ে অর্থনীতি সম্পর্কিত বিষয়েই পিএইচডি করি। গবেষণার নানা পর্যায়ে বিশেষ করে পিএইচডি থিসিসের কাজ করার সময় অনুভব করেছি অর্থনৈতিক গবেষণায় নির্ভরযোগ্য তথ্য-উপাত্ত কত গুরুত্বপূর্ণ। ২০০২-২০০৬ এই সময়কালে নেদারল্যান্ডসে পিএইচডি করার সময় অনুভব করেছি বাংলাদেশের উন্নয়ন, অগ্রগতির অতীত-বর্তমান-ভবিষ্যৎ এসব নিয়ে ভালো তথ্য-উপাত্ত সমৃদ্ধ comprehensive সমসাময়িক রিপোর্ট কত দুষ্প্রাপ্য! বিশেষ করে সার্বিক অর্থনৈতিক পরিকল্পনা দীর্ঘমেয়াদে কোন লক্ষ্যে এগোচ্ছে, সে ব্যাপারে কাঠামোগত কী ধরনের পরিবর্তন বা সহায়ক পরিবেশ দরকার, এরূপ বিষয়ে সরকারের দৃষ্টিভঙ্গি কোন দিকে আছে, সে সংক্রান্ত তথ্য পাওয়া খুব মুসকিল ছিল; বিভিন্ন রকম তথ্য গোছানো অবস্থায় এক জায়গায় তো ছিলই না।

আবার দেখতাম বিভিন্ন রির্পোটে উন্নয়নের নানা দিক নিয়ে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পলিসি সাজেশন থাকত, কি এগুলোর পারস্পরিক যোগসূত্রতা এবং একটি সুনিনির্দিষ্ট কাঠামোগত পর্যবেক্ষণ পাওয়া ছিল মুশকিল। পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা কিংবা পিআরএসপি ডকুমেন্টেগুলোর অগ্রগতি ও চ্যালেঞ্জ মোকাবিলার কৌশল নিয়ে মূল্যায়ন রির্পোট ছিল না বললেই চলে। তখন প্রায়ই মনে হতো পরিকল্পনা কমিশনের প্রণীত পরিকল্পনাগুলো আরও সুসংহত, সমৃদ্ধ কেন করা যাচ্ছে না। মনে হতো আমাদের উন্নয়নের মূল লক্ষ্য দারিদ্র্য বিমোচনকে সামনে রেখে কম্প্রিহেনসিভ একটি বাস্তবায়নযোগ্য পরিকল্পনা সত্যি সত্যি আছে কিনা।

এসব ভাবনার মাঝে অবাক হয়ে লক্ষ করলাম পরিকল্পনা কমিশন আমন্ত্রণ জানাচ্ছে নানান রকম সেমিনারে, যেখানে বিভিন্ন বিষয়ের ওপর গবেষণামূলক পরিকল্পনা উপস্থাপিত হচ্ছে। এর মধ্যে পরিবেশবান্ধব টেকসই উন্নয়নের দীর্ঘমেয়াদি পরিকল্পনা যেমন আছে, তেমনি আছে উন্নত বাংলাদেশ অর্জনের ১০০ বছরের পরিকল্পনা কিংবা দারিদ্র্য বিমোচনসহ আর্থিক অন্তর্ভুক্তি নিয়ে গবেষণা কিংবা জনব্যবস্থাপনা নিয়ে বিশেষ সেমিনার।

একের পর এক উন্নয়ন বিষয়ক নানান রকম গবেষণাকে উৎসাহিত করা, সেসব গবেষণালব্ধ ফলাফল নিয়ে উন্নয়ন পরিকল্পনাগুলোকে আরও বাস্তবভিত্তিক করার উদ্যোগ উল্লেখযোগ্যভাবে লক্ষ করেছি। আর এসব কর্মযজ্ঞের পেছনে যে শক্তি মূলত কাজ করেছে তা প্রফেসর শামসুল আলম। তাঁর নেতৃত্বে প্রণীত গবেষণা রিপোর্টগুলোর নানা তথ্য-উপাত্ত আমার নিজের গবেষণায় প্রচুর ব্যবহার করেছি; আমার গবেষণার ফলাফলকে মিলিয়ে নিতে পেরেছি সরকারের উন্নয়ন পরিকল্পনার সাথে। বিষয়টি যেন খুব সহজ হয়ে গেল হাতের কাছে পরিকল্পনা কমিশন কর্তৃক গত এক যুগে প্রণীত নানা রিপোর্ট থাকার কারণে।

এসডিজি বা টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা প্রণীত হওয়ার সাথে সাথে এই লক্ষ্যগুলো অর্জনের জন্য আমাদের বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কী ধরনের উদ্যোগ দরকার, এক্ষেত্রে কোথায় আমাদের তথ্য-উপাত্তে ঘাটতি আছে তা নিয়ে যত দ্রুত রিপোর্ট আমরা হাতে পেয়ে গেলাম, তা অতীতে ছিল অকল্পনীয়। প্রফেসর শামসুল আলমের নেতৃত্বে খুব দ্রুততার সাথে এই এসডিজিবিষয়ক কৌশলপত্র হাতে আসায় এবং কৌশল বাস্তবায়নের আর্থিক পরিকল্পনার একটি দিকনির্দেশনাও তৈরি হয়ে যাওয়ায়, টেকসই উন্নয়নের লক্ষ্যে পৌঁছানোর প্রস্তুতির সময়টা খুব সহজ হয়ে যায় বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য।

এর আগে এমডিজি বা সহস্রাব্দ উন্নয়ন লক্ষ্যের অগ্রগতির মনিটরিং প্রফেসর শামসল আলম যেভাবে করে গেছেন (প্রায় ১৮টি এমডিজিবিষয়ক প্রতিবেদন), ঠিক একইভাবে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনের পথে যাত্রার শুরু থেকেই তার মনিটারিং তা বাস্তবায়নে মন্ত্রণালয়ভিত্তিক কৌশলপত্রের দিকনির্দেশনা খুব স্পষ্ট করে দিয়েছেন, যা বিশেষ প্রশংসার দাবিদার। এভাবেই পরিকল্পনা কমিশনের বিশাল কর্মযজ্ঞের মাধ্যমে রাষ্ট্রের বৃহৎ পরিকল্পনাগুলো যেমন সামনে এসেছে তেমনি নানান রকম মূল্যায়নমূলক রিপোর্টের তথ্য-উপাত্তগুলো সহায়তা করেছে আরও বহ্ু গবেষককে তাদের গবেষণা পরিচালনা করতে। আমি মনে করি, গত এক যুগে উন্নয়নবিষয়ক পলিসি ওরিয়েন্টেড গবেষণায় এক নতুন গতি এসেছে, পরিকল্পনা কমিশনের গৃহীত নানা পরিকল্পনার বিচারে বিভিন্ন গবেষকের পরিচালিত গবেষণাকাজের মাধ্যমে। আর এসবই সম্ভব হয়েছে প্রফেসর শামসুল আলমের নতুনধারার চিন্তা-চেতনার কারণে, তাঁর সংশ্লিষ্টতার কারণে। তিনি তাঁর কাজের মাধ্যমে আরও অনেকের কাজকে এগিয়ে দিয়েছেন।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা প্রণয়নের সময় অর্থনীতিবিদ প্যানেলের সদস্য হিসেবে পুরো কাজটির সাথে সরাসরি জড়িত থাকার সময় আমি দেখেছি, প্রফেসর শামসুল আলমের নেতৃত্বদানের অসম্ভব ক্ষমতা। তিনি খুব সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য নিয়ে চলেন বলে আমার মনে হয়েছে। শুরু থেকেই বুঝে নেন কোন জায়গায় তিনি যেতে চান এবং সেই লক্ষ্যে কীভাবে যাবেন। তার কাজের গতি খুব দ্রুত। সেই গতির সাথে অন্যরা তাল মেলাতে না পারলে নিজেই করে ফেলেন অনেক কিছু, এটাই লক্ষ করেছি। কোনো বিষয়ে মতদ্বৈততা দেখা দিলে উনি সেটাকে অত্যন্ত বিনয়ের সাথে, কিন্তু খুব বুদ্ধিদীপ্ত কৌশল নিয়ে সমাধানের পথে গেছেন। একদিকে যেমন নিজের চিন্তাগুলো কমিটির সাথে খুব স্পষ্টভাবে শেয়ার করেছেন, আবার একইভাবে তার মধ্যে উদারতা দেখেছি অন্যের মতামত গ্রহণের। এমনকি এই অর্থনীতিবিদ প্যানেলের সর্বকনিষ্ঠ সদস্য হিসেবে আমি যখন বিভিন্ন মতামত দিয়েছি, কিংবা রিপোর্ট এর খসড়ায় কোনো ভুলত্রুটি ধরিয়ে দিয়েছি, তাতে তিনি নাখোশ হননি, বরং সেটাকে প্রশংসা করে কীভাবে সংশোধনে যাবেন তা জানিয়েছেন।

এভাবে জুনিয়রদের মতামতকে মূল্য দেয়া এবং সেগুলোকে গুরুত্বের সাথে নেয়ার মতো উদারতা খুব কম মানুষেরই থাকে। বাইরে থেকে কাজের মধ্য দিয়ে দেখে শুধু নয়, কাছ থেকে কাজ করেও দেখেছি, অসম্ভব পরিশ্রমী ও বিনয়ী ড. শামসুল আলম। তিনি অন্যদের কীভাবে কাজে লাগাতে হয় তা যেমন জানেন, ঠিক একইভাবে নিজেও পরিশ্রম করেন প্রচুর। আর গত ১২ বছরে অসংখ্য টিভি টক শোতে আমি অংশ নিয়েছি প্রফেসর শামসুল আলমের সাথে। আমি লক্ষ করেছি, বিভিন্ন রকমের প্রশ্নের উত্তর দিতে উনি সমসাময়িক পরিসংখ্যান অনেক ব্যবহার করেন, যা তার বক্তব্যকে সমৃদ্ধ করে। তার প্রণীত কোনো পরিকল্পনা কিংবা কোনো কাজের সমালোচনামূলক প্রশ্ন থাকলেও তাতে তাঁকে রাগ করতে দেখিনি, বরং যুক্তি দিয়ে বোঝানোর চেষ্টা করেছেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি ও চিন্তাভাবনা। টক শোতে বসে কোনো সমালোচনার উত্তরে তিনি যুক্তিকে আশ্রয় করেছেন, রাগকে নয়। লক্ষ করেছি, বিভিন্ন সেমিনারেও বক্তৃতা দিতে গিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট বিষয়ের বিভিন্ন দিকের ঐতিহাসিক পটভূমি, বর্তমানের পারিপার্শ্বিক বাস্তবতা তথ্য-উপাত্ত ও পরিসংখ্যানের মাধ্যমে খুব গুছিয়ে উপস্থাপনা করেন। ফলে যেকোনা সময় তাঁর বক্তব্যের মধ্যে অনেক ধরনের নতুন তথ্য থাকে, যা তাঁর বক্তব্যকে আকর্ষণীয় করে তোলে।

পেশাগত কাজের সুবাদে প্রফেসর শামসুল অলমকে যেভাবে দেখেছি, তাতে উনাকে খুব down to earth মানুষ মনে হয়েছে। এত উচ্চ পর্যায়ের একটা দায়িত্বে থাকার পরেও তাঁকে মনে হয় এমন একজন মানুষ, যার সাথে কোনো বিষয় নিয়ে সহজেই আলোচনা করা যায়, তিনি কী মনে করবেন না করবেন তা না ভেবেই। উনার সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে দেওয়া নানা মতামত থেকেও বিষয়টি বোঝা যায়। তিনি উদারচেতা মুক্তমনের মানুষ।

সব মিলিয় আমার কাছে প্রফেসর শামসুল আলম একজন গুণী মানুষ, চৌকস, পরিশ্রমী ও দক্ষ একজন অর্থনৈতিক পরিকল্পনাবিদ; সর্বোপরি একজন উন্নয়ন স্বপ্নদ্রষ্টা। তাঁর কাজের স্বীকৃতিতে যথাযথভাবেই একুশে পদক তিনি পেয়েছেন। তবে পদকের আশায় বসে থাকা মানুষ তাঁকে মনে হয়নি, মনে হয়েছে, কাজ তাঁর নেশা এবং আজীবন এই নেশাতেই তিনি ডুবে থাকতে চান। তাতেই যেন তাঁর শান্তি ও স্বস্তি। আর এর মাধ্যমে উপকৃত হচ্ছে ও হবে দেশ ও জাতি। সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রা আরেকটু সহজ-সুন্দর করতে সুন্দিষ্ট ও সুসংহত পরিকল্পনার কারিগর হিসেবে তিনি নিরলস যে কাজ করে যাচ্ছেন, তা জাতির উন্নয়ন অগ্রযাত্রায় গুরুত্বপূর্ণ অবদান হিসেবে সুস্পষ্ট থাকবে, এতে কোনো সন্দেহ নেই। অমি তাঁর সুস্বাস্থ্য ও সুদীর্ঘ কর্মজীবন কামনা করি।

ড. নাজনীন আহমেদ, সিনিয়র রিসার্চ ফেলো, বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজ (বিআইডিএস)।