এমন প্রজ্ঞাবান অর্থনীতিবিদকে আরও বড় দায়িত্ব দিলেও সাধারণ্যে প্রশংসিত হবে

আবু আহমেদ: আজকাল কৃতি অধ্যাপক তেমন দেখা যায় না। এখন অনেক অধ্যাপক বিখ্যাত হয়েছেন কর্মের দ্বারা নয়, দলীয় রাজনীতি করে পদ ভাগিয়ে। পড়ালেখা-গবেষণা-এসব কথিত অধ্যাপকদের মধ্য থেকে বিদায় নিয়েছে। ফলে আমরা বিশ্ববিদ্যালয় বা অন্য শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যাদের পাস করিয়ে সনদ দিয়ে বের করে দিচ্ছি, তারাও জ্ঞানে-মননে অনেকটাই ঘাটতিতে আছে।

আজকাল শামসুল আলম যে পদে সমাসীন আছেন, একসময় সে পদে পদায়ন পাওয়ার জন্য যোগ্য অধ্যাপকদের মধ্যে প্রতিযোগিতা হতো সরকার কাকে রেখে কাকে ওই পদে বসাবে তা নিয়ে অনেক চিন্তাভাবনা করত। আজ এই পদে যাওয়ার জন্য কি অনেক যোগ্য অধ্যাপক আছেন? ওই পদে গলাবাজি করে যারা অধ্যাপক হয়েছেন তারা কিছুতেই জুতসই হবেন না। তাই তাদের দেখা যায় কোনো একাডেমিক পদের জন্য না দৌড়ে বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের ভিসি হওয়ার জন্য দৌড়-ঝাঁপ দিচ্ছে কিংবা এসব অধ্যাপক অন্য কোনো পদের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন, যেখানে গবেষণা বা পড়ালেখার দরকার হয় না। অধ্যাপক ফাইল সই করে নিজেকে যখন বড় ভাবতে শুরু করেন তখন বুঝতে হবে আমাদের শিক্ষাঙ্গনে দুর্দিন চলছে। অনেক অধ্যাপক কোনো ভালো বিশ্ববিদ্যালয় থেকে একটি একাডেমিক অর্জন করতে কোনো গুরুত্ব দেননি। কোনো রকম অধ্যাপক হতে পারলেই হলো। বাকিটা তদবিরের জন্য তারা অন্য দরজাগুলো খোলার কাজে ব্যস্ত থাকেন। যে পদের কথা বলছিলাম বা যে পদে অধ্যাপক ড. শামসুল আলম আছেন সে পদ হলো পরিকল্পনা কমিশনের জেনারেল ইকোনমিকস ডিভিশনের সদস্য পদ। ওই পদে পদায়ন হতে হলে গবেষণা জানতে হবে। সর্বোপরি গ্রহণযোগ্য লেখা বা বিশেষণের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফলকে সবার সামনে তুলে ধরা জানতে হয়।

সম্পাদনায় দক্ষ হতে হবে। গবেষণা-লেখা-বিশ্লেষণের মাধ্যমে গবেষণার ফলাফলকে সবার সামনে তুলে ধরা জানতে হয়। গবেষণা-লেখা-বিশ্লেষণ এসব অনেক অধ্যাপকের সয় না। তাই যারা গবেষণা ও লিখতে জানেন সেই সঙ্গে জটিল বিষয়গুলোকে বিশ্লেষণের মাধ্যমে তুলে ধরতে সক্ষম হন তারা ওই পদের জন্য যোগ্য বিবেচিত হন। পরিকল্পনা কমিশন তথা সরকারের উ”চপদগুলোর মধ্যে জেনারেল ইকোনমিকস ডিভিশনের ওই সদস্য পদকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদ বলে ধরে নেওয়া যায়। ওই পদকে যারা শিক্ষিত ও জ্ঞানী তারা সম্মানের চোখে দেখেন, তারা জানতে চান ওই পদে কে আছেন? ড. শামসুল আলম আমার জানা মতে তার পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি সময় ওই পদে অবস্থান করছেন। ওই পদে যারা আগে পদায়ন হয়েছিলেন তারাও কৃতি শিক্ষক-অর্থনীতিবীদ ছিলেন। মধ্যখানে ওই পদটা গুরুত্ব হারাতে বসেছিল। এখন অবশ্য ওই পদের আগের অবস্থানে ফিরে গেছে। অনেক দলিল ওই পদে বসে লিখতে হয়, লিখতে গবেষণা করতে হয়, তথ্য বিন্যাস করতে হয়। শামসুল আলমের হাত দিয়ে বাংলাদেশ অর্থনীতি বিষয়ে অনেক গুরুত্বপূর্ণ দলিল রচিত হয়েছে। আমাদের সবার বিশ্বাস রয়েছে যেখানে ড. শামসুল আলম আছেন সেখানে প্রোগ্রামের অভাব হবে না, সেখানে আমরা যা পাব তা অনেকটা নিখুঁত এবং শুদ্ধভাবেই পাব।

শামসুল আলমের হাত দিয়ে আমাদের অষ্টম পঞ্চবার্ষিক (২০২০-২০২৫) পরিকল্পনা প্রণীত হয়েছে। এই কৃতি অধ্যাপক, গবেষক ও শিক্ষাবিদের হাত দিয়ে আজকে একশটার অধিক মূল্যায়ন, গবেষণা ও অধ্যয়ন গ্রন্থ প্রকাশিত হয়েছে। আজকে প্ল্যানিং কমিশনে গেলে বই-স্টাডি রিপোর্ট-এসব পেতে কোনো বেগ পেতে হয় না। এসব সহজসাধ্য হয়েছে একজন শামসুল আলমের জন্যই। তিনি তার মেধা ও পরিশ্রমের স্বীকৃতি পেয়েছেন, অনেক পদক, সনদ ইতোমধ্যেই তার ঝুলিতে স্থান পেয়েছে। কিন্তু এসব পদক, সনদ তাকে কখনো অহংকারী করতে পারেনি। আমরা যেমন শামসুল আলম থেকে শিখতে চাই, তেমনি তিনিও আমাদের কাছ থেকে শিখত আগ্রহী, এটাই তাঁর অনন্য বৈশিষ্ট্য।

বাংলাদেশে অর্থনীতিকে দীর্ঘদিন থেকে অতি নিকট থেকে তিনি দেখে আসছেন। এ সময় বাংলাদেশ অর্থনীতির সঠিক বিষয় অন্য কেউ শামসুল আলমের থেকে বেশি জানেন বলে মনে হয় না। অন্য কেউ জানতে পারেন, তবে আমাদের নজরে পড়েনি। একজন শামসুল আলম সরকারের জন্য অতি গুরুত্বপূর্ণ সম্পদ। জ্ঞানী, গবেষক, শিক্ষক, লেখক সর্বোপরি বিশ্বস্ত একজনকে সরকার পেয়েছে ড. শামসুল আলমের মতো। আজ বাংলাদেশ অর্থনীতির উচ্চপ্রবৃদ্ধির ধারায় আছে, সেক্ষেত্রে শামসুল আলমের অবদান অবশ্যই অনেক। শামসুল আলম স্বভাবে ভদ্র, বিনয়ী ও নীরব। কিন্তু কর্মে সরব।

ড. শামসুল আলমের আদি কর্মস্থল হলো ময়মনসিংহের বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়। সে বিশ্ববিদ্যালয় শামসুল আলমকে নিয়ে গর্ব করতে পারে। সরকার এমন একজন বিনয়ী অধ্যাপক, প্রজ্ঞাবান অর্থনীতিবিদকে আরও বড় দায়িত্ব দিলেও সেটা সাধারণ্যে গ্রহণযোগ্য এবং প্রশংসিত হবে।

অর্থনীতির চালকদের মধ্যে শামসুল আলম অনেক ওপরে। বাংলাদেশ অর্থনীতিতে তার মতো আরও অনেক যোগ্য চালক প্রয়োজন। আশা করি এখন যারা মাঝপথে আছেন, দেশে ও বিদেশে তাদের থেকে বাংলাদেশ অর্থনীতি অনেক যোগ্য চালক পাবে।

আবু আহমেদ: অর্থনীতিবিদ ও সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।