বিশিষ্টজনদের অভিমত: নির্যাতিত নারীর ন্যায়বিচারের পথ রুদ্ধ হলো

শাহনাজ পারভীন এলিস: রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণ মামলার রায় নিয়ে বিরূপ মন্তব্য করেছেন মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনেরা। আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামিকে খালাস দেওয়ায় এই রায়ের পুন:বিচার দাবি করেছেন তারা। বলেছেন, রায়ে আদালত ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পর মামলা গ্রহণ না করার নির্দেশনা দিয়েছেন। এতে নির্যাতিত নারীর ন্যায়বিচারের পথ শুধু রুদ্ধই হয়নি, অপরাধীদের আরও উৎসাহিত করা হয়েছে। রায়ের প্রতিক্রিয়ায় সংবাদ সারাবেলাকে এসব তথ্য জানিয়েছেন মানবাধিকার কর্মী ও বিশিষ্টজনেরা।

তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সাবেক উপদেষ্টা ও মানবাধিকার কর্মী সুলতানা কামাল বলেছেন, রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণীকে ধর্ষণ মামলার রায় অত্যন্ত হতাশাব্যাঞ্জক। পাশাপাশি রায়ের পর্যবেক্ষণে ভুক্তভোগী নারীরা কোন অবস্থায় ছিলেন, তাদের সংবেদনশীলতাকে আমলে নেওয়া হয়নি। নির্দেশনাটি কোনো বিচারেই সংগত হয়েছে বলা যায় না। ফৌজদারি অপরাধের বিরুদ্ধে মামলা করার কোনো সময়সীমা আমাদের প্রচলিত আইনব্যবস্থায় বেঁধে দেওয়া নেই। বিচারকের এ নির্দেশনা সম্পূর্ণ বেআইনি। ৭২ ঘণ্টা পেরিয়ে গেলে ধর্ষণের আলামত খুঁজে পাওয়া দুষ্কর হয়, সে কারণে এই সময়সীমা গুরুত্বপূর্ণ। অপরাধ নির্ণয়ে নানা সুযোগ আমাদের সামনে উন্মুক্ত হচ্ছে। ধর্ষণের মামলায় ডিএনএ পরীক্ষা তেমন একটি উপায়। অপরাধ যাতে প্রমাণ করা যায়, সে বিষয়ের ওপর জোর না দিয়ে বিচারক ঘটনার ৭২ ঘণ্টার পর মামলা না নেওয়ার নির্দেশনা দিয়ে ধর্ষণের শিকার মানুষের বিচার পাওয়ার পথে কঠিন অন্তরায় সৃষ্টি করলেন। রায়টি ধর্ষণ মামলায় বিচারপ্রার্থীর ন্যায়বিচার পাওয়ার মৌলিক উপায়ই বাধাগ্রস্ত করা হয়েছে। হতাশ হয়েছেন বিচারপ্রার্থী নারীরা।

জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী জানিয়েছেন, ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পর মামলা গ্রহণ করা যাবে না- আদালতের এ ধরণের নির্দেশনা মোটেই গ্রহণযোগ্য নয়। একজন পতিতাও যদি ধর্ষণের শিকার হন তার ন্যায়বিচার পাওয়ার আইনি অধিকার রয়েছে। অপরাধ যারা করেন তারা বেশিরভাগই প্রভাবশালী। এই রায় প্রভাবশালীদের অপরাধপ্রবণতা, অপরাধ করে প্রমাণ লোপাটের সুযোগ করে দেওয়া হয়েছে; যা আইনের শাসন ও ন্যায়বিচারের পরিপন্থী।

বিশিষ্ট সমাজকর্মী ও নিজেরা করি’র সমন্বয়ক খুশি কবির বলছেন, ‘মানুষ হিসেবে বিশেষ করে নারী হিসেবে বহুল আলোচিত রেইনট্রি হোটেলে দুই তরুণী ধর্ষণ মামলার রায় আমাকে আতঙ্কিত করে তুলেছে। ধর্ষণ একটি অপরাধ। এই অপরাধের সঙ্গে ভুক্তভোগীর পূর্ব ইতিহাসের কোন সম্পর্ক নেই। অপরাধ সংঘটিত করার পর নির্যাতিত নারীকে যদি ৭২ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় কোনভাবে আটকে রাখা হয় তাহলে তার বিচার পাওয়ার কোন উপায়ই থাকলো না। আমি মনে করি, এই রায় ঘোষণার আগে ভুক্তভোগী নারীরা কোন অবস্থায় ছিলো তা আমলেই নেওয়া হয়নি।’ ধর্ষণের মতো স্পর্শকাতর মামলায় এ ধরণের রায় ঘোষণার পর বিচারকের পর্যবেক্ষণে হতাশা ব্যক্ত করেন তিনি।

বহুল আলোচিত ধর্ষণ মামলার রায়ে সব আসামিকে খালাস দেওয়া বিস্ময়কর ও হতাশাব্যঞ্জক মনে করছেন বাংলাদেশ নারী সাংবাদিক কেন্দ্রে সভাপতি নাসিমুন আরা হক মিনু। তিনি বলেন, ধর্ষণের ঘটনায় এমনিতেই অনেক নারী মামলা করেন না। মামলা করলেও প্রভাবশালীদের চাপে তা চালিয়ে যেতে পারেন না এমন ঘটনা অনেক। তার ওপর ধর্ষণে ঘটনায় ৭২ ঘণ্টা পর মামলা গ্রহণ না করতে আদালতের এই নির্দেশনা বিচারপ্রার্থীর জন্য ন্যায়বিচারের অন্তরায় হবে। এই রায়ের পুন:বিচার দাবি করেন তিনি।

ঢাকার বনানীর রেইনট্রি হোটেলে চার বছর আগে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দিয়েছে আদালত।

বৃহস্পতিবার দুপুরে রাজধানীর বনানীর রেইনট্রি হোটেলে চার বছর আগে দুই তরুণীকে ধর্ষণের আলোচিত মামলার রায় ঘোষণা করেন ঢাকার ৭ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক বেগম মোছা. কামরুন্নাহার। রায়ে বহুল আলোচিত এই মামলার রায়ে আপন জুয়েলার্সের মালিকের ছেলে সাফাত আহমেদসহ পাঁচ আসামির সবাইকে খালাস দেন আদালত। মামলায় প্রধান আসামি আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদের ছেলে সাফাত আহমেদ। মামলার অন্য আসামিরা হলেন- সাফাতের বন্ধু সাদমান সাকিফ ও নাঈম আশরাফ ওরফে এইচএম হালিম, সাফাতের দেহরক্ষী রহমত আলী ও গাড়িচালক বিল্লাল। রায় ঘোষণার সময় পাঁচ আসামিই আদালতে উপ¯ি’তি ছিলেন৷

বিচারক রায়ের পর্যবেক্ষণে বলেন, ‘তদন্ত কর্মকর্তা প্রভাবিত হয়ে এ মামলায় অভিযোগপত্র দিয়েছেন। ভুক্তভোগীর মেডিকেল রিপোর্টে কোন যৌন হয়রানির (সেক্সুয়াল ভায়োলেশন) বিবরণ নেই। ভুক্তভোগীর পোশাক থেকে পাওয়া ডিএনএ নমুনা আসামিদের সঙ্গে মেলেনি। ঘটনার ৩৮ দিন পর এসে তারা বললো ধর্ষিত হয়েছি বিষয়টি তদন্ত কর্মকর্তার বিবেচনা করা উচিত ছিল। তা না করে তদন্ত কর্মকর্তা আদালতের কর্ম সময় (পাবলিক টাইম) নষ্ট করেছেন, পুলিশ যেন ঘটনার ৭২ ঘণ্টা পর কোন ধর্ষণ মামলা গ্রহণ না করে।’