সুপুরুষ – সজ্জন – কর্মবীর ড. শামসুল আলম

এম এম আকাশ: শামসুল অলমের বয়স কত হবে তা যদি আপনাকে জিজ্ঞেস করি, আমি নিশ্চিত যে সুপুরুষ শামসুল আলমের বয়স আপনার উত্তর অনুযায়ী নিশ্চয়ই তাঁর প্রকৃত বয়সের তুলনায় অনেক কম হবে। তার পরিপাটি বেশভূষা এবং নিখুঁতভাবে ব্যাক ব্রাশ করা একদা ভ্রমরকৃষ্ণ চুল দেখে আমার তাকে প্রথমে খুব একটা বয়স্ক মনে হয়নি। কিন্তু আজ এই লেখা লিখতে গিয়ে সম্পাদক প্রেরিত জীবনবৃত্তান্ত থেকে বুঝতে পারলাম তাঁর বয়স পার হয়ে গেছে এর পরেও সম্প্রতি তিনি করোনা যুদ্ধে জয়ী হয়েছেন। কামনা করি তিনি যেন দীর্ঘজীবী হন।

তাঁর সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয়ের সূত্রপাত পরিকল্পনা কমিশনের সভাকক্ষে যেখানে আমরা অর্থনীতিবিদরা সাধারণ অর্থনীতি বিভাগ (সংক্ষেপে জিইডি বা General Economic Division of Planning Commission) এর আমন্ত্রণক্রমে আলোচনা সভায় বা ‘প্যানেল ডিসকাশনে’ (Panel Discussion) মাঝে মাঝে মিলিত হতাম।

এসব সভার মধ্যমণি ছিলেন তিনি। সরকারের একজন প্রভাবশালী সিনিয়র সচিব (প্রশাসনিক ক্যাডারদের বাইরে থেকে তিনিই সম্ভবত বাংলাদেশে প্রথম রাষ্ট্রপতি মনোনীত সিনিয়র সচিব হতে পেরেছিলেন) হিসেবে তিনি এসব সভা পরিচালনার শুরুতে যেসব বক্তব্য দিতেন, তাতে দুটো জিনিস আমার কাছে প্রথম থেকেই পরিষ্কার হয়ে গিয়েছিল। প্রথমত, তিনি একজন জাত শিক্ষক। আমাদেরই পেশাভুক্ত লোক (Fellow Men) পরে Gll অবশ্য জেনেছি যে তাঁর শিক্ষকতার চাকরি জীবন শুরু হয়েছিল ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে। আর তাঁর রয়েছে সর্বমোট ৩৫ বছরের দেশে-বিদেশে শিক্ষকতার অতীত অভিজ্ঞতা। ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন সমাজ ও রাজনীতি-সচেতন শিক্ষক হিসেবে বঙ্গবন্ধুর আমল থেকেই তিনি ময়মনসিংহের বিভিন্ন প্রগতিশীল সভা-সমিতিতে যেতেন- বক্তৃতাও দিয়েছেন- সম্মানিতও হয়েছেন- শিক্ষক হিসেবে ছাত্রদের কাছে জনপ্রিয়তাও তাঁর অটুট ছিল।

সুতরাং অনেকের মতো আমিও খুশি ছিলাম পরিকল্পনা কমিশন একজন অ-আমলা শিক্ষককে নেতৃত্ব দিতে রাজি হয়েছেন দেখে। এটা অনেকটাই ছিল আমাদের প্রথম পরিকল্পনা কমিশনের নেতৃত্বদানকারী শিক্ষক অর্থনীতিবিদ চতুষ্টয়ের ঐতিহাসিক ধারাবাহিকতার অনুরূপ। পরে যত দিন গেছে তত নিশ্চিত হয়েছি ড. শামসুল আলম শুধু একজন জ্ঞানী শিক্ষক ছিলেন না, ছিলেন অন্তরের দিক থেকে গণতান্ত্রিক প্রগতিশীল একজন ব্যক্তি।

খুবই মৃদুভাষী, নিরহংকার, অতি সজ্জন এক ভদ্রলোক। পরিকল্পনা কমিশনের সভাগুলোতে তিনি বয়োজ্যেষ্ঠ অর্থনীতিবিদদের থেকে কোনো একজনকে সভাপতি পদে অধিষ্ঠিত করে সভা শুরু করে দিতেন। নিজে কথা বলতেন খুব কম। কিন্তু যেসব বিষয়ে তিনি আমাদের পরামর্শ চাইতেন তা নিয়ে সূচনা বক্তব্যে একটি সামগ্রিক সংক্ষিপ্ত স্পষ্ট উপস্থাপেনর মাধ্যমে সভার কাজ শুরু করতেন। তিনি একজন ভালো উপস্থাপক।

এসব সভার প্রকৃতি ছিল প্রায়ই পাঁচমিশালি। নানা মতের, নানা স্তরের (Level), নানা পেশার, নানা সংস্থার প্রতিনিধিরা সেখানে উপিস্থত থাকত। তাঁদের মধ্যে কেউ কেউ প্রায়ই অপ্রাসঙ্গিক ও দীর্ঘ বক্তব্যও দিতেন। কেউ কেউ সরকারের তীব্র না হলেও খোলামেলা সমালোচনাও করতেন। ড. আলম অত্যন্ত ধৈর্যসহ স্মিত হাসি দিয়ে সব বক্তব্যই শুনে যেতেন। শেষে সভাপতি শেষ করার আগে তিনি সভা থকে যতটুকু পেলেন তা পুনরায় ব্যক্ত করে সভা শেষ হতো। আমার এ পর্যন্ত অংশগ্রহণ করা কোনো সভায় তাঁকে আমি উত্তেজিত হতে বা অপ্রীতিকর কোনো সংলাপে নিয়াজিত হতে দেখিনি।

ড. আলম প্রচলিত অনেক আমলার মতো শুধু হুকুম প্রদান এবং লাল ফিতার পর লাল ফিতা বেঁধে ফাইল পেন্ডিং রেখে কখনো সময় পার করেননি। তাহলে এত কাজ তিনি এত অল্প সময়ে শেষ করতে পারতেন না। সব সময় নিজে ব্যস্ত থাকতেন এবং অন্যদের ব্যস্ত রাখতেন। তাকে সম্ভবত নানা ধরণের কাজ এক সঙ্গে করতে হতো।

আমি এই গ্রন্থের সম্পাদকের কাছে থেকে পাওয়া জীবনবৃত্তান্তটি ঘেঁটে একটি ব্যস্ততা সমৃদ্ধ জীবন ও সেই জীবনের সমৃদ্ধ কর্মতালিকা দেখতে পাচ্ছি। নিচের তালিকাটি থেকে আপনারাও একটি ধারণা পাবেন:
ক) ১৯৭৪ থেকে ২০১৫ তিনি মূলত ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করে।
খ) বাইরে বিদেশে পড়তে গিয়েছেন, প্রথমে অর্থনীতিতে এমএ ব্যাংককে, পরে পিএইচডি ডিগ্রি অর্জন করেছেন ইংল্যান্ডের নিউ ক্যাসল থেকে।
গ) ফিরে এসে বিশ্ববিদ্যালয়ে যোগ দিয়ে প্রচুর গবেষণা করেছেন।
ঘ) ‘ভিজিটিং টিচার’ হিসেবে বিভিন্ন দেশি-বিদেশি বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন।
ঙ) দেশের নানা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিন্ডিকেট ও বোর্ডে প্রতিনিধি নির্বাচিত হয়েছেন। শুধু এক মেয়াদ নয়, কোনো কোনোটায় চার মেয়াদব্যাপী।
চ) ইউএনডিপি, জাতিসংঘ ও ফাও-এ স্বল্পকালীন গবেষণাধর্মী চাকরিও করেছেন।
ছ) এরপর ২০০৯ থকে ২০২১ অর্থাৎ এখন পর্যন্ত চলছে তাঁর প্রধান কীর্তিময় কাজ অর্থাৎ এখন পর্যন্ত তিনি কাজ করে যাচ্ছেন বাংলাদেশ পরিকল্পনা কমিশনের সদস্য ও সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের প্রধান হিসেবে।
জ) এই বারো বছরে তার হাতে লেখা বা তার তত্ত্বাবধানে প্রণীত এবং/অথবা লিখিত হয়েছে যেসব উল্লেখযোগ্য দলিল সেগুলো হচ্ছে : ১। পরিমার্জিত দারিদ্র্য বিমোচন কৌশলপত্র (২০০৯-১১), ২। ‘রূপকল্প ২০২১’ (সরকারের নির্বাচনী ইশতেহারসমূহ), ৩। রূপকল্প ২০২১-এর আলোকে বাংলাদেশের প্রথম দীর্ঘমেয়াদি প্রেক্ষিত পরিকল্পনা (২০১০-২১), ৪। ষষ্ঠ পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১১-১৫), ৫। সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০১৬-২০), ৬। অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা (২০২১-২০২৫) এবং ৭। ‘শতবর্ষী ব-দ্বীপ পরিকল্পনা-২১০০’।

আমাদের মনে রাখতে হবে, মাত্র বারো বছরে এতগুলো মূল্যবান রাষ্ট্রীয় দলিল (এগুলোসহ মোট ১১৪টি গ্রন্থ) প্রণয়নের সাফল্য দুর্লভ। এটা প্রমাণ করে যে ড. আলমের রয়েছে অবিরাম কর্মপ্রেরণা ও সাংগঠনিক প্রতিভা। এসব দলিল প্রণয়নের আগে অসংখ্য Background Research করতে ও করাতে হয়েছে তাঁকে। বহু দেশ-বিদেশের প্রতিভাবান কিন্তু সময়ের ব্যাপারে প্রায়ই উদাসীন লেখক-গবেষকদের কাছ থেকে বলেকয়ে তাঁদের গবেষণামূলক প্রবন্ধগুলো আদায় করা চাট্টিখানি কথা নয়। তারপর সেগুলোর সংশ্লেষণ, সংশ্লেষণের পর পুনরায় রাজনৈতিক কর্তৃপক্ষকে তা বুঝিয়ে অনুমোদন করানো এবং অবশেষে এগুলোর প্রশাসনিক বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান, কাগজপত্রে, ভেতরে-বাইরে নানা ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া সামলানো, আমাদের মতো নানা ধরনের অর্থনীতিবিদ ও লোকদের সঙ্গে অবিরাম সংলাপ চালানো-সবই এই সময় তাঁকে মুখ বুজে কঠোর পরিশ্রমসহ দিনের পর দিন চালিয়ে যেতে হয়েছে। এর মধ্যে তাকে বিদেশে যাওয়া-আসাও করতে হয়েছে অনেকবার। অসীম ধৈর্য ও কর্মস্পৃহা না থাকলে এটা সম্ভব হতা না।

কিন্তু এটুকুই শেষ নয়। এত কাজের ফাঁকে ফাঁকে তিনি নিজে ব্যক্তিগতভাবে লিখেছেন মোট ১৫টি গ্রন্থ আরও অনেক গ্রন্থ হয়তো প্রকাশের অপেক্ষায় রয়েছে। দেশে-বিদেশে জার্নালে প্রকাশিত হয়েছে তাঁর নিজস্ব ৪৫টি গবেষণা নিবন্ধ। দেশের মূল দৈনিক পত্রিকাগুলাতে প্রায়ই প্রকাশিত হয় তাঁর বাংলায় সুলিখিত কলামসমূহ।

আমি অনেক সময় এ ধরণের কর্মবীরদের দেখে বিস্মিত হয়ে ভাবি-কীভাবে এতকিছু সম্ভব হচ্ছে। নিশ্চয়ই পরিবারকে হয়তো তেমন সময় দেওয়া তাঁর পক্ষে সম্ভব হয়নি। যদিও জানতে পেরেছি যে, তাঁর রয়েছে স্ত্রী, দুই পুত্র ও দুই নাতনি নিয়ে একটি সুখী সংসার। তাদের সহযোগিতারও নিশ্চয় এখানে হয়তো বড় অবদান রয়েছে। তাদেরও আমাদের ধন্যবাদ জানানো উচিত।

অভিনন্দন ড. আলম
আমাদের দেশে সাধারণত খ্যাতিমান-কীর্তিমান লোকদের মৃত্যুর পর সম্মান রীতি প্রচলিত আছে। তবে আমি বিশ্বাস করি সহকর্মীরা চাইলে জীবিত অবস্থাতেই সত্যিকার কীর্তির স্বীকৃতি দিতে পারেন ও দেওয়া উচিত। ওই ব্যক্তির জন্য নিশ্চয়ই অনুপ্রেরণাদায়ক হবে এবং আমরা অনেকেই তা থেকে নিজেরাও হয়তো অনুপ্রাণিত হব, শিখতে পারব।

ড. আলম আমাকে ব্যক্তিগত আলাপে জানিয়েছিলেন যে, এরকম ‘আত্মপ্রচার’-এ তাঁর নিজের আগ্রহ ছিল না। প্রধান সম্পাদক মহোদয় ও বন্ধুবান্ধব তাকে বলেকয়ে রাজি করিয়েছেন। আমি বলবো, এরূপ বিনয়ই তাঁর জন্য স্বাভাবিক ও প্রত্যাশিত। কিন্ত তাঁকে অভিনন্দন জানানোও আমাদের দায়িত্ব এবং সেটা মৃত্যুর পর নয়, মৃত্যুর আগে হওয়াই বাঞ্জনীয়।
অভিনন্দন ড. আলম।

লেখক: এম এম আকাশ : অধ্যাপক অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়