একজন পরিকল্পনাবিদ ড. শামসুল আলমকে যেভাবে দেখেছি

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ: ড. শামসুল আলম ব্যক্তিগতভাবে আমার খুব প্রিয় ব্যক্তিদের একজন। যদিও কৃষি অর্থনীতিবিদদের কাছে তার মূল পরিচয় ওই বিষয়ের শিক্ষক ও গবেষক হিসেবে, দেশের সুধী সমাজে এখন তিনি সরকারের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা প্রণয়নের কেন্দ্রীয় ব্যক্তিত্ব হিসেবেই বেশি পরিচিত। তার নেতৃত্বে ও সক্রিয় অংশগ্রহণে দেশের ইতিহাসে সর্বাধিক সংখ্যক আর্থসামাজিক পরিকল্পনা-সংক্রান্ত প্রতিবেদন প্রণীত ও প্রকাশিত হয়েছে। এর কারণ শুধু এই নয় যে তিনি পরিকল্পনা কমিশনের বর্তমান পদে দীর্ঘতম সময় ধরে অধিষ্ঠিত আছেন, বরং এটা তার কর্মময়তা ও কর্তব্যপরায়ণতারই প্রতিফলন। বলতে গেলে বাংলাদেশের বিগত এক যুগের অর্থনৈতিক পরিকল্পনা তৈরির কর্মকাণ্ড আর ড. শামসুল আলমের নাম প্রায় সমার্থক হয়ে গেছে।

এ প্রসঙ্গে একটা হাস্যরসাত্মক গল্প মনে পড়ল। যুক্তরাষ্ট্র আফ্রিকান সম্প্রদায়ের সুদীর্ঘ পারিবারিক ইতিহাস অবলম্বনে এলেক্স হেইলি তার কয়েক প্রজন্মের পারিবারিক ইতিহাস নিয়ে ‘রুটস’ নামের বিখ্যাত উপাখ্যান রচনা করেছেন, যা টেলিভিশন সিরিয়াল হিসেবেও প্রচুর জনপ্রিয়তা পায়। একবার এক অনুষ্ঠানে পৌঁছাতে দেরি হওয়ার কারণ হিসেবে তিনি বলেছিলেন, পথে এক বন্ধুর সঙ্গে দেখা হলে তাকে জিজ্ঞেস করল, আপনার পরিবার কেমন আছে? অনুরূপ পরিস্থিতিতে ড. আলমও অনায়াসে বলতে পারবেন আসার পথে এক বন্ধু জিজ্ঞেস করল দেশের পরিকল্পনা কেমন চলছে। পরিকল্পনা প্রণয়নের সুদীর্ঘ অভিজ্ঞতা নিয়ে তিনি যদি পরবর্তীকালে একটি স্মৃতিচারণমূলক বই লেখেন তা সুধী সমাজে প্রচুর সমাদৃত হবে বলে আমার বিশ্বাস। অর্থনীতির বিষয় নিয়ে প্রাঞ্জল ভাষায় পত্রপত্রিকায় লেখালেখিতে তিনি বেশ সিদ্ধহস্ত।

ড. আলমের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের সূত্রপাত ষষ্ঠ পাঁচসালা পরিকল্পনা তৈরির সূত্র ধরে। জানি না কেন ওই পরিকল্পনার প্যানেল অব ইকোনমিস্টের নেতৃত্বে আমাকে রাখতে তিনি অনেকটা গোঁ ধরেই বসলেন। এরপর অবশ্য ধারাবাহিকভাবে ষষ্ঠ, সপ্তম ও অষ্টম পাঁচসালা পরিকল্পনা ও প্রেক্ষিত পরিকল্পনার ক্ষেত্রও ওই একই দায়িত্বে তার অনুরোধে আমি থেকে গেছি। অবশ্য ওইসব দায়িত্বে আমি যে উল্লেখযোগ্য কোনো অবদান রাখতে পেরেছি তা একেবারেই নয়। তবে এই সময়ের মধ্যে তার সঙ্গে ব্যক্তিগত ঘনিষ্ঠতা বেড়েছে এবং কাছ থেকে তার কাজকর্ম দেখার সুযোগ হয়েছে। পরিকল্পনা প্রণয়ণের ক্ষেত্রে যতদূর নিরপেক্ষ ও বস্তুনিষ্ঠভাবে দেশের অর্থনীতির বাস্তব চিত্র ও সম্ভাবনা তুলে ধরা যায়, তিনি একনিষ্ঠভাবে সে বিষয়ে সচেষ্ট ছিলেন। কোনো সরকারি প্রতিবেদন এত নিরপেক্ষভাবে তৈরি করা সহজ কথা নয়। এমনকি তিনি পাঁচসালা পরিকল্পনাগুলোর মধ্যমেয়াদে মূল্যায়ন প্রতিবেদনও প্রকাশ করেছেন, যেখানে লক্ষ্যমাত্রার সঙ্গে প্রকৃত অর্জনের তারতম্য তুলে ধরা হয়েছে। প্রতিটি পরিকল্পনাকালে সংগত কারণেই সরকারের রাজস্ব আয়ের সঙ্গে প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দের ভারসাম্যের সমস্যা প্রকটভাবে ধরা পড়েছে।

বিশেষত স্বাস্থ্য ও শিক্ষা খাতে পর্যাপ্ত ব্যয় বরাদ্দের জন্য যে সরকারের রাজস্ব সংগ্রহ জোরদার করা প্রয়োজন তা পরিকল্পিত আয়-ব্যয়ের হিসাব দিয়ে স্পষ্টভাবে তুলে ধরা হয়েছে। এটাও সরকারি দলিলের জন্য একটি ব্যতিক্রমধর্মী দৃষ্টান্ত। তাঁর দৃঢ়তার প্রশংসা করতেই হবে। আলমের তত্ত্বাবধানে শতবর্ষ মেয়াদের একটি ডেল্টা প্ল্যানও তৈরি করা হয়েছে। এত দীর্ঘমেয়াদের পরিকল্পনা নিয়ে অবশ্যই অনেক অনিশ্চয়তা ও বিতর্কের অবকাশ থাকবে। বিশেষত বাংলাদেশের মতো একটি ব-দ্বীপ অঞ্চলের পানিসম্পদ ব্যবস্থাপনার বিকল্প কৌশল নিয়ে এমনিতেই অতীতে অনেক বিতর্ক হয়েছে এবং বিশেষজ্ঞদের মধ্যে মতৈক্যে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। তার ওপর বিশ্বব্যাপী আবহাওয়া পরিবর্তনের প্রভাবে পরিবেশের ভারসাম্যের ওপর কতখানি বিপর্যয়ের আশঙ্কা আছে সে নিয়ে তো আরও অনেক বড় অনিশ্চয়তা রয়েছে। সেক্ষেত্রে এত দীর্ঘমেয়াদে পরিকল্পনা তৈরি করা তো যথেষ্ট সাহসেরও একটা বিষয়। এর ওপর আলোচনা-বিতর্ক তিনি উৎসাহিত করেছেন। ড. আলমের সান্নিধ্যে যারাই এসেছে এক বাক্যে স্বীকার করবে যে তার মতো অমায়িক সদালাপী মানুষ খুব বিরল। তবে একজন সদা কর্মব্যস্ত এই অর্থনীতিবিদ মানুষটির মধ্যে যে একটা শৈল্পিক মন লুকিয়ে আছে তার সন্ধান বোধ হয় খুব কম মানুষই পেয়েছে। আমি পেয়েছি ঘটনাচক্রে ফেসবুকে দেওয়া আমার আইডি হতে আঁকা কিছু ছবিতে তার সুন্দর মন্তব্য থকে। যেমন একটি ল্যান্ডস্কেপ আর্ট দেখে তিনি যথার্থই মন্তব্য করেছিলেন রবীন্দ্রনাথের গানের একটি উদ্ধৃতি দিয়ে:
‘আকাশ আমায় ভরল আলোয় আকাশ আমি ভরব গানে।’ আমি ড. আলমের সুদীর্ঘ জীবন ও সুস্বাস্থ্য কামনা করি।

ওয়াহিদউদ্দিন মাহমুদ অথনীতিবিদ, সাবেক তত্ত্বাধায়ক সরকারের উপদেষ্টা ও সাবেক অধ্যাপক, অর্থনীতি বিভাগ, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়।