আইনের চোখে পরকীয়া

সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পাবেন

পরকীয়া একটি “নিষিদ্ধ” সম্পর্কের নাম। দাম্পত্য জীবনে সবচেয়ে জটিল সম্পর্কের একটি। নিষিদ্ধ জিনিষের প্রতি মানুষের অমোঘ আকর্ষণ থাকে। বলতে গেলে এটি মানুষের প্রকৃতিজাত অভ্যাস। এই সম্পর্কের অশুভ প্রলয়ে ধ্বংসের মুখে আজ পরিবার প্রথা। কারণ, নিষেধাজ্ঞা পেলেই যেন বিষয়টির ওপর আকর্ষণ বেড়ে যায়।

বিষয়টি সমাজে নানা কারণেই বেশ আলোচিত। চারপাশে দেখা যায়, অনেকেই সন্তানের ভবিষ্যত চিন্তা করে নিরবে সহ্য করে যাচ্ছে সঙ্গীর এই নিষিদ্ধ সম্পর্ক। অনেকেই আবার বেছে নিচ্ছে আত্মহত্যার মতো অভিশপ্ত পথ। কেউ কেউ পরকীয়া নামের নরক যন্ত্রণা সহ্য করতে না পেরে ঘটাচ্ছেন বিবাহবিচ্ছেদ।

বাংলাদেশ দণ্ডবিধি আইনের ৪৯৭ ধারায় ব্যভিচারের শাস্তি উল্লেখ করা হয়েছে। এ আইনে বলা হয়েছে, যদি কোনো ব্যক্তি অন্য কোনো লোকের স্ত্রী জানা সত্ত্বেও বা সেটা বিশ্বাস করার অনুরূপ কারণ রয়েছে এমন কোনো নারীর সঙ্গে স্বামীর সম্মতি ছাড়া যৌন সম্পর্কে আবদ্ধ হোন এবং অনুরূপ যৌন সম্পর্ক যদি ধর্ষণের অপরাধ না হয়, তাহলে সে ব্যক্তি ব্যভিচারের দায়ে দায়ী হবেন, যার শাস্তি সাত বছর পর্যন্ত যে কোনো মেয়াদের সশ্রম বা বিনাশ্রম কারাদণ্ড বা অর্থদণ্ড অথবা উভয় দণ্ড দণ্ডিত করা যাবে।

এক্ষেত্রে নির্যাতিতাকে অন্য লোকের স্ত্রী হতে হবে। তবে ব্যভিচারের ক্ষেত্রে নারীদের কোনো শাস্তির বিধান আইনে নেই।

১৮৬০ সালে ইংরেজ শাসনকালে তৈরি তথা প্রায় দেড়শ বছরের পুরনো দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারাটি বাংলাদেশের সংবিধানের ২৭, ২৮ ও ৩২ অনুচ্ছেদের সঙ্গে সাংঘর্ষিক। এতে নারী ও পুরুষকে আলাদাভাবে বিবেচনা করা হয়েছে। যা একজন নারীর জন্য অপমানজনক। এটা সংশোধন প্রয়োজন। আর এই নিয়ে হাইকোর্টে রিট পিটিশন করা হয়েছে ২০১৯ সালে তার পরিপ্রেক্ষিতে ব্যাভিচার সংক্রান্ত দণ্ডবিধির ৪৯৭ ধারা কেন অসাংবিধানিক ঘোষণা করা হবে না তা জানতে চেয়ে রুল জারি করেছিলেন হাইকোর্ট।

সংবিধানের ২৭ ও ২৮ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, সব নাগরিক আইনের দৃষ্টিতে সমান এবং আইনের সমান আশ্রয় লাভের অধিকারী এবং রাষ্ট্র ও গণজীবনের সর্বস্তরে নারী-পুরুষ সমান অধিকার পাবেন। এছাড়া ৩২ অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, আইন ব্যতীত জীবন ও ব্যক্তি-স্বাধীনতা হতে কোনো ব্যক্তিকে বঞ্চিত করা যাবে না।

ভারতসহ দক্ষিণ এশিয়ার অধিকাংশ দেশে ফৌজদারি আইন হিসেবে ১৮৬০ সালে ব্রিটিশ সরকারের তৈরি করা দণ্ডবিধিই প্রয়োজন মতো বদলে নিয়ে চালু রাখা হয়েছে। ভারতের সুপ্রিম কোর্টও আইনটিকে “নারীদের জন্য অপমানজনক” হিসেবে বর্ণনা করে। বিশ্বের বেশিরভাগ দেশ ব্যভিচার আইন ইতোমধ্যে বাতিল করে দিয়েছে উল্লেখ করে ভারতের সুপ্রিম কোর্ট ৪৯৭ ধারাটি বাতিল করে দিলেও বলেছে, ব্যভিচার “অপরাধ নয়”!

ভারতীয় সমাজের একটা বড় অংশ এই রায়ের সমর্থক হলেও তবে অনেকেই বলছেন, এই রায়ের ফলে পরিবার ও সমাজ জীবনে নৈরাজ্য দেখা দেবে। ভারতীয় অনেক বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গের মতে, এই রায়ের পরিণাম ভয়ংকর হবে। একটা ছেলে বা মেয়ে এ ধরনের স্বাধীনতা পেলে উচ্ছৃঙ্খল জীবন যাপন শুরু করবে। ফলে পরিবার জীবনে সংকট তৈরি হবে বলে মনে করেন তারা। তারা আরও বলেন, ‘‘বহুগামী মহিলার সন্তানের বাবা কে, তা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে৷ ডিএনএ পরীক্ষার প্রয়োজন পড়বে৷ এ সকল পরিস্থিতি সন্তানের ভবিষ্যৎ সংকট তৈরি করবে। এছাড়া বহুগামী স্ত্রীর সাথে বিবাহ বিচ্ছেদ নিতে চাইলে স্বামীকে বিশাল অংকের পরিমাণ টাকা ক্ষতিপূরণ দিতে হবে৷ তার সংসারও ভাঙবে, আর্থিক ক্ষতিও হবে৷’’ এছাড়া কিছু বিশেষ ব্যক্তিবর্গ বলেছেন, “পরকীয়া বৈধ হলে সম্পর্কের বাঁধন থাকবে না৷ সম্পর্কের শাসন না থাকলে তা কিভাবে টিকবে?”

ভারতের সুপ্রিম কোর্টের রায়ে পরকীয়া আর অপরাধ নয়। এই রায়ের মাধ্যমে নতুন বিতর্কের সূত্রপাত। অনেকে বলছেন, নারীর অধিকারকে পূর্ণতা দিয়েছে এই রায়৷ আবার অনেকের মতামত অনুযায়ী, এই স্বাধীনতা পারিবারিক ও সমাজ জীবনে ভয়ংকর পরিণাম ডেকে আনবে৷ বেলা শেষে পরিবার প্রথা কি ভাঙনের পথে এগুবে? আমাদের দেশেও রেকর্ড সংখ্যক পরকীয়ার খবর প্রকাশিত হয়েছে, প্রতিদিন খবরের কাগজে পরকীয়া নিয়ে বিভিন্ন অপরাধের খবর প্রকাশিত হচ্ছে। মায়ের হাতে শিশু পর্যন্ত হত্যার শিকার হয়েছে। স্বামীর দ্বারা স্ত্রী হত্যার খবর প্রতিনিয়ত শোনা যাচ্ছে। এ ধরনের অপরাধ সমাজকে কোথায় নিয়ে যাবে আমরা কি একবার ভেবে দেখছি? আইন প্রণয়ন করেও কি পরকীয়া/ব্যাভিচার ঠেকানো সম্ভব হবে?